নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) অভ্যন্তরে এক বন্দীর খাবার জোরপূর্বক খেয়ে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারাবন্দীদের গণপিটুনির শিকার হয়েছেন একাধিক হত্যা মামলার আসামি ও আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সরদার আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেল (৪৩)।
একাধিক সূত্র সহ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বনফুল ভবনের রাইটার মোবারক হোসেন রকি।
কারা–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাভার পৌরসভার আরাপাড়া এলাকার দুর্ধর্ষ বন্দী সাজুর সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টা করছিলেন আপেল মাহমুদ। বার বার নিষেধ সত্ত্বেও আপেল শামীমের সেলে প্রবেশ করতেন এবং এক পর্যায়ে শামীমের অনুপস্থিতিতে তার কেনা খাবার খেয়ে ফেলেন।
এ ঘটনা জানাজানি হলে শামীম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আপেল প্রথমে তা অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে স্বীকার করায় অন্য বন্দীদের হাতে তিনি গণপিটুনির শিকার হন। তদন্তে নেমে কারা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, শামীম একা নন—আপেল মাহমুদ বহু বন্দীর খাবার গোপনে খেয়ে নেওয়াসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বনফুল ভবন থেকে ‘মেটভবন’ (মানসিক সংশোধন ও কাউন্সেলিং সেল)–এ স্থানান্তর করে কাউন্সেলিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
একসময়ের ‘সাভারের আতঙ্ক’ লেগুনা আপেলের উত্থান :
সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াবাড়ি ভাটপাড়া এলাকার মৃত শুক্কুর মুন্সি ওরফে শুক্কুর কসাই–এর ছেলে আপেল মাহমুদ এক দশক আগেও ছিলেন সাধারণ লেগুনা চালক। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদখল ও অস্ত্রবাজির জগতে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, সাভার উপজেলা পরিষদের সাবেক (পতিত) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম রাজিবের ঘনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবেই তার উত্থান ঘটে।
৫ আগস্ট ও পূর্ব মুহূর্তের আন্দোলনে হামলা ও একাধিক মামলার কেন্দ্রবিন্দু :
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলন চলাকালে সশস্ত্রভাবে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা, সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাঙচুর, রাতের আঁধারে বাড়িঘরে তাণ্ডব, লুটপাট ও বিরোধী নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হামলা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে—দুই ডজনের বেশি হত্যা মামলা, ধর্ষণ, হত্যা চেষ্টা, অস্ত্র মামলা, চাঁদাবাজি ভূমিদখলের অভিযোগসহ একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ:
আপেল মাহমুদের বিরুদ্ধে একাধিক সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— স্থানীয় দৈনিক ফুলকির সম্পাদক ও সাভার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নাজমুস সাকিব, সাভার উপজেলা সাংবাদিক সমিতির আহবায়ক ও দৈনিক মানবজমিনের রিপোর্টার সোহেল রানা, সাভার প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক রওশন আলী, ৭১ টেলিভিশনের সুফিয়ান ফারাবী, দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টার শামীম হোসেন, দৈনিক আজকের বসুন্ধরা পত্রিকার রিপোর্টার আব্দুস সালাম রুবেল,দৈনিক জনবানি পত্রিকার রিপোর্টার মবিনুর রহমান রবিনসহ জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল বাংলা লাইভের ক্যামেরা পার্সন নয়ন।
অভিযোগ রয়েছে, দৈনিক মানবজমিনের সাংবাদিক ও সাভার উপজেলা সাংবাদিক সমিতির আহবায়ক সোহেল রানার বিরুদ্ধে আপেল তার নিজ অনুসারী যুবলীগ নেতা বিটলা শাহজাহানকে দিয়ে একটি মিথ্যা মামলা করান। বর্তমানে সেই মিথ্যা মামলা দায়েরের অপরাধে দন্ডবিধির ২১১ ধারায় আপেল মাহমুদ ও বিটলা শাহজাহান আসামি হিসেবে পিবিআই রিপোর্টে পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই মামলায় সোহেল রানাকে এখন বাদী হিসেবে নিয়েছে আদালত। আপেল মাহমুদ ও বিটলা শাহজাহান একাধিক হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
লেগুনা আপেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন মনজুরুল আলম রাজীবের অপর দুই অনুসারি আপেলের সহযোগী কথিত দুই সাংবাদিক। এবার তাদেরকেও আইনের আওতায় আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সাভার বাসী। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র।
আলোচনায় প্রবাদ—‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’
কারাগারে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, খাবার চুরির মতো আচরণের পর বন্দীদের মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে বহুল প্রচলিত প্রবাদ—
“ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।”
যার মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছেন, লেগুনা আপেলের অপরাধী স্বভাব পরিবর্তন কঠিন।
কারা সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বন্দীকে আলাদা সেলে রেখে মানসিক কাউন্সেলিং চলমান এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে।